ঢাকা ০৮:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’

নিজস্ব সংবাদ :

২০২৪ সাল বাঙালি জাতির জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরটি শুরু হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও একতরফা ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তবে ছয় মাস পার না হতেই, জনগণের তুমুল আন্দোলনে তার ক্ষমতার মসনদ উল্টে যায়। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ শুরু হয়। নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সিস্টেমবিরোধী স্লোগান আর ব্যতিক্রমী কর্মসূচি। এসব স্লোগান আন্দোলনকারীদের মাঝে উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়।

প্রথমদিকে অহিংস আন্দোলন চললেও ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় তা সহিংস হয়ে ওঠে। এরপর আন্দোলনের প্রধান দাবি হয়, সরকার পতনের এক দফা। ৩৬ দিনের এই আন্দোলনে নতুন নতুন স্লোগান সৃষ্টি হয়। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে সরকার পতনের দাবি-৩৬ দিনের এই আন্দোলনের শেষ তিন সপ্তাহে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান, বদলেছে দাবির ভাষাও।

‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’-এর মতো শ্লেষাত্মক স্লোগান ধীরে ধীরে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে ওঠে বজ্রকঠিন স্লোগান,‘এক, দুই, তিন, চার; শেখ হাসিনা গদি ছাড়।’মাঝের তিন সপ্তাহে যে স্লোগানগুলো শোনা গিয়েছিল, সেখানে আছে ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ এবং ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’-এর মতো আরও অনেক স্লোগান। এইসব স্লোগানগুলো শুধু মুখেই থেমে থাকেনি; প্ল্যাকার্ড, ব্যানার আর পোস্টারেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে আন্দোলনের গতি আর এসব স্লোগান তীব্র হয়ে ওঠে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এর পর থেকেই স্লোগান শুরু হয়, ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’ এবং ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’-এসব স্লোগান।

এরপর পরিস্থিতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান। বর্তমান প্রজন্মের মুখে উঠে এসেছে আগের প্রজন্মের শব্দ-বাক্যও। যেমন ২ আগস্ট রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও’ এবং ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’। ৩ আগস্ট ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ থেকে শোনা যায়, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’; ‘আমার ভাই জেলে কেন’ এবং ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’-সব স্লোগান।

সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে শোনা যায়, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ এবং ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’-এর মতো স্লোগানগুলো।

১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানটি আন্দোলনে নতুন গতি দিয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানটি। এর পাশাপাশি শব্দে লেখা স্লোগানগুলোও সমান শক্তি নিয়ে আন্দোলনে লংমার্চ করে। মানুষের হাতে হাতে দেখা যায় সেই জ্বলন্ত বার্তাগুলো। মিছিলে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানারে মানুষ লিখে নিয়ে এসেছিল কবিতার পঙ্ক্তি। সেখানে ছিল জহির রায়হান থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজের লেখা কবিতা। উঠে এসেছিল কার্টুনে কার্টুনে ব্যঙ্গচিত্রও।

ছাত্র-জনতার স্লোগানগুলো শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ ছিল না, উঠে এসেছিল প্ল্যাকার্ডেও। ‘অনাস্থা অনাস্থা, স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা’; ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ’; ‘তবে তাই হোক বেশ, জনগণই দেখে নিক এর শেষ’; ‘আমরা আম-জনতা, কম বুঝি ক্ষমতা’; ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’; ‘ফাইট ফর ইওর রাইটস’; ‘নিউটন বোমা বোঝো মানুষ বোঝো না’ লেখার মতো শ্লেষাত্মক প্ল্যাকার্ডও ছিল হাতে হাতে।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৩:০৮:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
৩২ বার পড়া হয়েছে

‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’

আপডেট সময় ০৩:০৮:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

২০২৪ সাল বাঙালি জাতির জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরটি শুরু হয়েছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও একতরফা ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তবে ছয় মাস পার না হতেই, জনগণের তুমুল আন্দোলনে তার ক্ষমতার মসনদ উল্টে যায়। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ শুরু হয়। নতুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সিস্টেমবিরোধী স্লোগান আর ব্যতিক্রমী কর্মসূচি। এসব স্লোগান আন্দোলনকারীদের মাঝে উত্তেজনার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়।

প্রথমদিকে অহিংস আন্দোলন চললেও ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় তা সহিংস হয়ে ওঠে। এরপর আন্দোলনের প্রধান দাবি হয়, সরকার পতনের এক দফা। ৩৬ দিনের এই আন্দোলনে নতুন নতুন স্লোগান সৃষ্টি হয়। অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং ভারতে পালিয়ে যান। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে সরকার পতনের দাবি-৩৬ দিনের এই আন্দোলনের শেষ তিন সপ্তাহে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান, বদলেছে দাবির ভাষাও।

‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’-এর মতো শ্লেষাত্মক স্লোগান ধীরে ধীরে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে ওঠে বজ্রকঠিন স্লোগান,‘এক, দুই, তিন, চার; শেখ হাসিনা গদি ছাড়।’মাঝের তিন সপ্তাহে যে স্লোগানগুলো শোনা গিয়েছিল, সেখানে আছে ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ এবং ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’-এর মতো আরও অনেক স্লোগান। এইসব স্লোগানগুলো শুধু মুখেই থেমে থাকেনি; প্ল্যাকার্ড, ব্যানার আর পোস্টারেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে আন্দোলনের গতি আর এসব স্লোগান তীব্র হয়ে ওঠে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর। ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এর পর থেকেই স্লোগান শুরু হয়, ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’ এবং ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’-এসব স্লোগান।

এরপর পরিস্থিতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান। বর্তমান প্রজন্মের মুখে উঠে এসেছে আগের প্রজন্মের শব্দ-বাক্যও। যেমন ২ আগস্ট রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও’ এবং ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’। ৩ আগস্ট ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ থেকে শোনা যায়, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’; ‘আমার ভাই জেলে কেন’ এবং ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’-সব স্লোগান।

সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে শোনা যায়, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ এবং ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’-এর মতো স্লোগানগুলো।

১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানটি আন্দোলনে নতুন গতি দিয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানটি। এর পাশাপাশি শব্দে লেখা স্লোগানগুলোও সমান শক্তি নিয়ে আন্দোলনে লংমার্চ করে। মানুষের হাতে হাতে দেখা যায় সেই জ্বলন্ত বার্তাগুলো। মিছিলে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ব্যানারে মানুষ লিখে নিয়ে এসেছিল কবিতার পঙ্ক্তি। সেখানে ছিল জহির রায়হান থেকে শুরু করে হেলাল হাফিজের লেখা কবিতা। উঠে এসেছিল কার্টুনে কার্টুনে ব্যঙ্গচিত্রও।

ছাত্র-জনতার স্লোগানগুলো শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ ছিল না, উঠে এসেছিল প্ল্যাকার্ডেও। ‘অনাস্থা অনাস্থা, স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা’; ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ’; ‘তবে তাই হোক বেশ, জনগণই দেখে নিক এর শেষ’; ‘আমরা আম-জনতা, কম বুঝি ক্ষমতা’; ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’; ‘ফাইট ফর ইওর রাইটস’; ‘নিউটন বোমা বোঝো মানুষ বোঝো না’ লেখার মতো শ্লেষাত্মক প্ল্যাকার্ডও ছিল হাতে হাতে।